সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০৩:০২ পূর্বাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
প্রাণঘাতী যুদ্ধ ও রাজনৈতিক নানা তরজার মধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু খবর বেশ স্বস্তিদায়ক। এমনই কয়েকটি খবরে শিরোনাম হলো ‘বেতন দিতে না পেরে স্কুল ছেড়েছিলেন, ৬১ বছর পর দিলেন সেই বেতন।’ ‘অনুশোচনাবোধ থেকে ট্রেনভ্রমণের বকেয়া টাকা পরিশোধ।’ ‘বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণ, ৮ বছর পর ভাড়া পরিশোধ।’
বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত খবরগুলো খুবই ছোট, কিন্তু তাৎপর্যবহ। এসব খবরে সমাজের জন্য রয়েছে অনেক বার্তা ও শিক্ষণীয় বিষয়। নিজের ভেতরে জন্ম নেওয়া আত্মোপলব্ধি থেকে এমন ছোট অঙ্কের অনুচ্চারিত তাগাদাবিহীন ঋণ পরিশোধ উত্তম মানসিকতার পরিচায়ক। এটাকে শরিয়তের ভাষায় বলে, তাকওয়া। তাকওয়াকে সহজ বাংলায় বলা হয় আল্লাহভীতি। অর্থাৎ যতই গোপনে আমি কোনো অন্যায় করি না কেন, তা আল্লাহ জানেন। তার জানা-শোনার বাইরে কিছু নেই। হতে পারে, কাজটি ছোট, কোনো সাক্ষী-প্রমাণ নেই কিন্তু একজন এটা দেখছেন, তিনি আল্লাহ। সব ধরনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়ে কোনো পাপ থেকে বিরত থাকা, অতীতে করা কোনো পাপের জন্য তওবা করা, কারও অধিকার নষ্ট করে থাকলে তা পূরণ করার নামই তাকওয়া।
তাকওয়া সব ভালো কাজের উৎস, পুণ্য কাজের জন্য পথের দিশারী। তাকওয়া হচ্ছে- ভালো কাজের মাধ্যমে আল্লাহর আজাব থেকে বেঁচে থাকা। আগের ও পরের সব উম্মতকে তাকওয়া অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর নিশ্চয়ই আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম তোমাদের আগে যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছিল তাদের এবং তোমাদেরও; যেন তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো।’ -সুরা আন নিসা : ১৩১
অনেকেই হয়তো স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সময় কিংবা আরও আগে না জেনে, অথবা সত্যিকারের প্রয়োজনে এমন ঋণে জড়িয়ে আছেন, এ জাতীয় খবরগুলো পড়ে তার মনে চেতনা সৃষ্টি হলে তিনিও ঋণ পরিশোধে উদ্বুব্ধ হবেন। এই ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে তিনি ঋণমুক্ত হলেন। ঋণমুক্তির ফজিলত প্রসঙ্গে কোরআন-হাদিসে প্রচুর বর্ণনা রয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, সমাজের অনেকেই নানা সময়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে যাতায়াত করেন এবং এটাকে কোনো অন্যায় মনে করেন না। শরিয়তের পরিভাষায় কিন্তু এটা ঋণ। টাকার পরিমাণ অল্প হলেও, পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে বিদ্যালয়ের কিংবা রেলওয়ে বিভাগের বাকি টাকা তারা পরিশোধ করে ঋণমুক্ত জীবন পেলেন, এদেশে এরকম হাতেগোনা কজন লোক আছেন, কেউ বলতে পারেন? এ জাতীয় খবরের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কিংবা ব্যক্তির কাছে ঋণ রেখে অনেকের মৃত্যুর খবরও আমার পত্রিকার পাতায় পড়ি। তুলনামূলক বিশ্লেষণে যার মধ্যে ন্যূনতম বোধ আছে, তিনিই বলবেন ঋণ পরিশোধকারী উত্তম, ঋণ রেখে মৃত্যুবরণকারীর তুলনায়। তিনি যত বড় ব্যক্তিই হোন না কেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে ঋণ পরিশোধ করা আবশ্যক। এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, নবী কারিম (সা.) বলেছিলেন, যদি বাহরাইনের মাল এসে যায় তাহলে আমি তোমাকে এত এত দেব। কিন্তু নবী কারিম (সা.)-এর মৃত্যু পর্যন্ত বাহরাইনের মাল এসে পৌঁছায়নি। পরে যখন বাহরাইনের মাল পৌঁছল, হজরত আবু বকর (রা.)-এর আদেশে ঘোষণা করা হলো, নবী কারিম (সা.)-এর কাছে যার অনুকূলে কোনো প্রতিশ্রুতি বা ঋণ রয়েছে সে যেন আমার কাছে আসে। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, নবী কারিম (সা.) আমাকে এত এত দেবেন বলেছিলেন। তখন হজরত আবু বকর (রা.) আমাকে এক অঞ্জলি ভরে দিলেন, আমি তা গণনা করলাম এতে পাঁচশ ছিল। তারপর তিনি বললেন, এর দ্বিগুণ নিয়ে যাও। -সহিহ বোখারি : ২২৯৬
উল্লিখিত হাদিসে মৃত ব্যক্তির ঋণ আদায় ও অঙ্গীকার পূরণ করার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। শরিয়তের দৃষ্টিতে দাফন-কাফনের পর মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে ওয়ারিশদের ঋণ পরিশোধ করা আবশ্যক। ওয়ারিশরা ঋণ আদায় করা বা ঋণদাতা ক্ষমা করা ছাড়া মৃত ব্যক্তি কখনো দায়মুক্ত হবে না। মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে ঋণ আদায়ের পর ওয়ারিশরা অবশিষ্ট সম্পত্তির মালিক হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এর সবই (তারা পাবে) সে যা অসিয়ত করে তা দেওয়ার এবং ঋণ পরিশোধের পর।’ -সুরা নিসা : ১১
ইসলামের শিক্ষা হলো, যদি মৃত ব্যক্তি ঋণ পরিশোধের মতো পর্যাপ্ত সম্পদ রেখে না যায় এবং অন্য কেউ তা পরিশোধ করে দেয়, তবে তা আদায় হয়ে যাবে এবং আদায়কারী ব্যক্তি উপযুক্ত প্রতিদান পেয়ে যাবে। হজরত সালামা ইবনে আকওয়া (রা.) থেকে বর্ণিত একদিন নবী কারিম (সা.)-এর কাছে জানাজা নামাজের জন্য এক ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হলো। তখন নবী কারিম (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, তার কি কোনো ঋণ আছে? সাহাবিরা বললেন, না। তখন তিনি তার জানাজার নামাজ আদায় করলেন। তারপর আরেকটি জানাজা উপস্থিত করা হলো। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার কি কোনো ঋণ আছে? সাহাবিরা বললেন, হ্যাঁ।
তিনি বললেন, তোমাদের সাথীর নামাজে জানাজা তোমরাই আদায় করে নাও। হজরত আবু কাতাদা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! তার ঋণের দায়দায়িত্ব আমার ওপর। তখন তিনি তার জানাজার নামাজ আদায় করলেন। -সহিহ বোখারি : ২২৯৫
ঋণ একটি আর্থিক দায়। যা ব্যক্তির ওপর আদায় করে দেওয়া আবশ্যক। এটি হক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্বাভাবিক অবস্থায় ঋণী হওয়াকে ইসলাম অনুৎসাহিত করে। কখনো ঋণী হয়ে গেলে যথাসম্ভব দ্রুত ঋণ বা দায় থেকে মুক্ত হতে বলা হয়েছে। কোনো কারণে ঋণখেলাপি অবস্থায় মারা গেলে পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনের আগেই ঋণ আদায় করে দিতে হয়। সুতরাং ঋণ আদায় না করার কোনো সুযোগ নেই। ঋণ আদায় না করা কবিরা গোনাহ। ঋণখেলাপি বড় জালেম।
অনেক সময় এমন হয়, ঋণখেলাপি ঋণ আদায় না করেই মারা গেছে। মৃত্যুর পর কোনো কারণে তা আদায় করা হয়নি। তাহলে সেটি তার পরকালীন সফলতার জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হলেও ঋণ অনাদায়ী থাকলে তা জান্নাতে প্রবেশে প্রতিবন্ধক হবে বলে হাদিসে বলা হয়েছে। অন্যদিকে ঋণমুক্ত থাকা জান্নাতে প্রবেশে সহায়ক। হজরত ছাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যার রুহ তার শরীর থেকে বের হয়ে যায় তথা ইন্তেকাল করে, আর তখন সে তিনটি বিষয় থেকে মুক্ত থাকে তথা অহংকার, সম্পদ আত্মসাৎ ও ঋণ তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ -জামে তিরমিজি : ১৫৭৩
তবে ঋণগ্রস্ত যদি সত্যিকারভাবে অভাবী হয়, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। ইসলামের বিধানে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি সম্পদ অপচয় ও অপব্যয় না করে এবং ইচ্ছা থাকার পরও ঋণ শোধ করে না যেতে পারে অথবা ঋণ পরিশোধের মতো সম্পদ রেখে যেতে না পারে, তবে পরকালে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। ঋণী হওয়া ভালো নয়। স্বাভাবিক বিবেকবুদ্ধিও একে পছন্দ করে না। ঋণী হওয়ার অর্থ নিজের কাঁধে অন্যের বোঝা বহন করা। নবী কারিম (সা.) ঋণের বোঝা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতেন। তিনি ঋণগ্রহণকে শঙ্কা ও দুশ্চিন্তার কারণ আখ্যা দিয়েছেন। ঋণের মাধ্যমে জীবনকে সংকটাপন্ন করতে নিরুৎসাহিত করেছেন। সুতরাং আমাদের উচিত কারও জিম্মায় এ জাতীয় ব্যক্তিগত কিংবা প্রতিষ্ঠানিক কোনো ঋণ থাকলে তা দ্রুত পরিশোধ করা। দায়মুক্ত হয়ে কাল কেয়ামতের মাঠে আল্লাহর সামনে হাজির হওয়া।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
muftianaet@gmail.com